-মাহ্ফুজুল হক
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র একটি বিখ্যাত উক্তি : যে দেশে গুণীর কদর নেই সে দেশে গুণীর জন্ম হতে পারে না।

বাজারঘাটার মেইন রোড থেকে সামান্য দক্ষিণে গিয়ে মেইন রোডের প্যারালাল পূর্ব-পশ্চিমমুখী লেইন/গলির একতলা ছোট্ট বাড়িটিই মূলতঃ জামায়াতের অঘোষিত মরকজ। সকল শলা-পরামর্শ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, বাস্তবায়ন তথা সর্ববিধ সাংগঠনিক কাজ সেই ঘর কেন্দ্রিক। সেই ঘরে যিনি বাস করেন তাঁর কিছু বলা, কিছু না বলা, কথা বলার জন্যই এই লেখার অবতারণা। তিনি দীর্ঘদেহী এক সুপুরুষ, মুখে চাপ দাড়ি, মাথার চুল কিছুটা কোকড়ানো, প্যান্ট-শার্ট-কোট-টাই পড়া পুরা দস্তুর এক সাহেব। তিনি কক্সবাজার সাব জজ কোর্টের (পরবর্তীতে জজ কোর্ট) সিনিয়র আইনজীবী। তিনিই আজকের আলোচ্য পুরুষ ছালামতুল্লাহ্। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ এর মতো ঐতিহ্যবাহী, বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ইসলামি দলের কক্সবাজার জেলা শাখার সেক্রেটারী, পরবর্তীতে আমীর। পদবিতে যদিও সেক্রেটারী কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তিনিই মূল কর্মবিধায়ক। জেলা আমীর আবু সাবের সাহেবের কক্সবাজার শহরে কদাচিৎ উপস্থিতি তাঁকে যাচিত বা অযাচিতভাবে মূল কর্মবিধায়কের আসনে অধিষ্টিত করেছে। বহুমুখী কর্মতৎপরতা, কোর্ট-কাছারি তথা প্রশাসনের মূল কেন্দ্রে তাঁর সদা উপস্থিতি ও সহজপ্রাপ্যতা, ব্যাপক পরিচিতি, সর্বোপরি দ্বীনের প্রতি তাঁর ঐকান্তিকতা ও নিষ্ঠা তাঁকে জামায়াতের মূল ব্যক্তির আসনে বসিয়েছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী অত্যন্ত কঠিন ও ঝঞ্ছাবিক্ষুব্ধ সময়ে কক্সবাজারে যাঁরা ইসলামি আন্দোলন তথা জামায়াতে ইসলামীর হাল ধরেছিলেন তাঁদের কয়েকজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য জনাব ছালামতুল্লাহ্। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, ক্রীড়া, শিক্ষা, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, মানব সেবা সর্বত্র তাঁর সমান পদচারণা। আর তাঁর উপস্থিতি মানেই জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব। কক্সবাজারে জামায়াত আর ছালামতুল্লাহ্ একাকার হয়ে গিয়েছিলো। দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের কারণে কেউ তাঁকে অসম্মান বা অবজ্ঞা করতে পারতেন না। তিনি একাধারে ইসলামি ব্যক্তিত্ব আবার কৃতি ফুটবলার, একদিকে উকিল হিসেবে আইনের চর্চা করেন আবার অন্যদিকে স্কাউট্স কমিশনার হিসেবে শারীরিক কসরত করেন। তিনি একদিকে ইসলামি জলসায় কোরআন-হাদিসের আলোকে বয়ান করেন আবার সাংস্কৃতিক অঙ্গণে নজরুল-রবীন্দ্র-ফররুখ বিষয়ক সারগর্ভ বক্তব্য রাখেন। রাজনীতির অঙ্গণেও একদা মুসলিম ছাত্রলীগ পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামী।

তিনি ইসলামি আন্দোলনের কাজে কক্সবাজার জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম-গঞ্জ চষে বেড়ান অন্যদিকে আবার (সীরু ফিল আরদ্) যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আমন্ত্রণে ইন্টারন্যাশনাল ভিজিটরস প্রোগ্রামের আওতায় আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি, ক্যালিফোর্নিয়া, কলম্বিয়া, বার্লিংটন, ফ্রিপোর্ট, স্যানদিয়াগো, শিকাগো প্রভৃতি স্থান ভ্রমণ করেন। আমেরিকার এই প্রোগ্রামটি এতোই মর্যাদাপূর্ণ যে, বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট গোলাম ইসহাক খান, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রানা সিংহ প্রেমাদাসা, ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও বিভিন্ন সময়ে অংশ নিয়ে তথায় সফর করেন। রাবেতা আলমে ইসলামি কর্তৃক আমন্ত্রিত হয়ে পবিত্র হজ¦ পালন ও দেশে ফেরার পথে আরব আমিরাতের বাংলাদেশ সমিতি ও ইসলামিক সেন্টার এর সদস্যদের আমন্ত্রণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবী, দুবাই প্রভৃতি স্থান পরিদর্শন করেন। স্কাউটিং গ্রুপ লিডার হিসেবে তিনি পাকিস্তানের করাচীতে অনুষ্ঠিত অল পাকিস্তানের প্রথম জাতীয় জাম্বুরীতে অংশগ্রহণ করেন।

অসহায়, দুর্দশাগ্রস্ত, রোগাক্রান্ত, অসচ্ছ্বল পরিবারের ছাত্র, কন্যাদায়গ্রস্ত লোকজন প্রায় সময় তাঁর কাছে আসতেন আর তিনিও যথাসাধ্য তাদের সহায়তা, বুদ্ধি-পরামর্শ ও ভরসা দিতেন। শুধু মুসলিম নন, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী মানুষও বিশেষভাবে পূজা উদযাপন পরিষদের সদস্যবৃন্দ বিভিন্ন প্রয়োজনে তাঁর কাছে আসতেন আর তিনি তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ইত্যাদি দিতেন। হিন্দুদের পূজা-পার্বণে তাদের মন্ডপে সশরীরে গিয়ে অভয় দিতেন। অর্থাৎ তিনি সর্বস্তরের মানুষের মনে ভরসা-নির্ভরতার জায়গায় পরিণত হয়েছিলেন। মানুষ মনে করতেন, ছালামতুল্লাহ্ এমন এক ব্যক্তি যাঁকে তাঁদের মনের কথাগুলো বলা যায়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, পরিচালনা ইত্যাকার কাজের ব্যাপারে তাঁর তৎপরতা চোখে পড়ার মতো ছিলো। ইসলামীয়া বালিকা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা তাঁর জীবনের কেবলমাত্র একটি স্বপ্নই নয় বরং ছিলো এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আর তিনি সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন এবং দীর্ঘদিন ধরে তা মোকাবিলা করেছিলেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে। এই লেখকও ওই চ্যালেঞ্জের কিছুটা অংশ ছিলেন বটে। কতিপয় সাংগঠনিক ভাইয়ের সাথে আমরাও তারাবনিয়ারছরা থেকে আনা ওই মাদ্রাসার বেড়া, খুঁটি, ঢেউ টিন ইত্যাদি বহন করে একবার গাড়ির মাঠ, একবার ওয়াপদার পাশর্^বর্তী খালি জায়গা এবং সর্বশেষ বর্তমান স্থলে ঘুরেছি আর নানা প্রতিকূলতা সয়েছি। তিনি লোকেদের কাছে ধর্ণা দিয়ে দিয়ে মাদ্রাসার জন্য জিনিস-পত্র, ফান্ড সংগ্রহ করতেন। এমনও দেখেছি, জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ শুরা মিটিং চলছে। তিনি হঠাৎ উধাও। ঘন্টার উপরে অপেক্ষা করতে করতে সদস্যগণ কাহিল, কিছুটা বিরক্তও। পরে জানা গেল, তিনি বিদায়ী জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন (কক্সবাজারের ২য় ডিসি) এর কাছে ধর্ণা দিতে গেছেন বালিকা মাদ্রাসার বর্তমান জমিটি লীজ পাবার জন্য। বিদায়ী জেলা প্রশাসক বিমানের সিঁড়ির কাছাকাছি পৌঁছেছেন আর তথায় ছালামতুল্লাহ্ ফাইল নিয়ে হাজির এবং শেষ পর্যন্ত তিনি ডিসি সাহেবের সই আদায় করে ছাড়লেন। প্রশ্ন জাগতে পারে, এই মাদ্রাসার প্রতি কেন তাঁর এতো আগ্রহ ? ইসলামীয়া বালিকা মাদ্রাসা ছিলো সমগ্র বাংলাদেশে মেয়েদের আলাদাভাবে ইসলামি শিক্ষার প্রথম প্রচেষ্টা। একটি আন্দোলন। এটি সফলভাবে প্রতিষ্ঠিত হবার পরে এদেশে বহু বহু বালিকা মাদ্রাসা হয়েছে। এক শ্রেণির মানুষ বিশেষভাবে তথাকথিত আলেম নামধারী বালিকা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছেন সক্রিয়ভাবে। ফতোয়াও দিয়েছেন, নারীদেরকে ঘরের বাহির করা হচ্ছে ইত্যাদি বলে। পরে শত শত মেয়েকে হাতে বই-খাতা নিয়ে বোরকা-হিজাব পরিহিত অবস্থায় রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে মন ভরে যেতো। এখন সারা দেশে মহিলাদের ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করার যে প্রয়াস এবং বোরকা-হিজাবের যে ব্যাপক প্রচলন সর্বত্র দেখা যায় তার শিরোনামে আছে কক্সবাজারের ইসলামীয়া বালিকা মাদ্রাসা। এক কথায় বলা যায়, কক্সবাজারের ইসলামীয়া বালিকা মাদ্রাসা বাংলাদেশে বালিকাদের ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করার আন্দোলনের অগ্রদূত। এছাড়াও মহিলা কলেজ, সিটি কলেজ, শহীদ তিতুমীর ইনস্টিটিউট, আল হেরা একাডেমী প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার একেবারে গোড়ার সময় যে দৌঁড়-ঝাপ, সর্বত্র ছালামতুল্লাহ্র সক্রিয় পদচারণা। হাশেমিয়া আলীয়া মাদ্রাসায় তাঁকে প্রায়ই দেখা যেতো। তিনি ছিলেন মাদ্রাসা গভর্নিং বডির সদস্য। আমি তথায় শিক্ষক হিসেবে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে দেখি তিনি সেখানে উপস্থিত। কক্সবাজার আইন কলেজের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ইসলামি আইনের অধ্যাপক এবং প্রথম ভাইস প্রিন্সিপাল।

তাঁর কাজগুলো জটিল কিন্তু তাঁর মাঝে বাস করে শিশুসুলভ বালখিল্যতা। জানাযার প্রাক্কালে তাঁর ছোট সন্তান শাকিলও তাঁর মাঝে বিরাজমান সরলতার কথা বললেন। কোলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘মুহাম্মদী’ পত্রিকায় ছোটদের পাতায় তাঁর লেখার কথা এক্ষেত্রে স্মর্তব্য।

আমি মাঝে মাঝে দ্বিধায় পড়ে যাই তাঁকে কি নামে সম্বোধন করবো তা নিয়ে। তিনি একাধারে রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী, ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ-শিক্ষানুরাগী, মানবাধিকার কর্মী, ইসলামি ব্যক্তিত্ব, আইনজ্ঞ, স্কাউটস কমিশনার। বিষয় বা পদ-পদবি যাই হোক না কেন, তিনি সর্বাবস্থায় সফলতার শিখরে পৌঁছে গেছেন। রাজনীতিতে তিনি কক্সবাজার জেলা জামায়াতের আমীর, কেন্দ্রীয় শুরা সদস্য। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে কক্সবাজার-রামু আসন থেকে জামায়াতের পক্ষ থেকে এমপি পদের জন্য তিনি দুই দুইবার নির্বাচনে লড়েন। সমাজকর্মীরূপে ইসলামি সমাজ কল্যাণ সংসদের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এই সংসদের উদ্যোগেই ফী বছর আয়োজন করা হতো তৎকালীণ সময়ের সর্ববৃহৎ তফসীরুল কোরআন মাহফিল। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বক্তা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব তথায় লাখো জনতার মাহফিলে পবিত্র কোরআন মজিদের তফসীর পেশ করতেন।

ক্রীড়া ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি তদানীন্তন কক্সবাজার মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

কক্সবাজারে সাংবাদিকতার বিকাশ ও প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠায় তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁর নেতৃত্বে কক্সবাজারে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির শাখা এবং প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠা হয়। কক্সবাজার প্রেসক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি এর আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যকরি কমিটির সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস), এসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান (এপিপি), অবজারভার, জনপদ প্রভৃতির কক্সবাজার প্রতিনিধি হিসেবে তিনি কাজ করেন।

এতো ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি লেখালেখি করতেন। পড়াশুনাও করতেন প্রচুর। কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমির তিনি আজীবন সদস্য ছিলেন। তাঁর লিখিত দু’টি গ্রন্থ : ‘কোরআনের আলোকে সাংবাদিকতা’ এবং ‘আমেরিকা ও আমেরিকার দিনগুলো’ কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমিই প্রকাশ করে। কক্সবাজারে নবীনদের লেখা নিয়ে হাতে লেখা সাহিত্য পত্রিকা তাঁর উদ্যোগেই প্রথম প্রকাশিত হয়।

মানবতা, মানবিকতা, মানবাধিকার প্রভৃতি সদ্গুণাবলী মানুষের প্রতি পরম মমত্ববোধ থেকেই আবভর্িূত হয়। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার কক্সবাজার শাখার সভাপতির পদটি তিনি দীর্ঘদিন অলংকৃত করেছেন মানুষের প্রতি তাঁর পরম মমতাবোধের প্রেরণা দ্বারা উজ্জীবিত হয়েই।

আইনজীবী হিসেবেও তিনি সফল। একেতো সিনিয়র আইনজীবী, বহু নবীনকে জুনিয়ররূপে পাশে রেখে আইন চর্চা শিখিয়েছেন, আইনজীবীদের কল্যাণার্থে অবদান রেখেছেন, জেলা আইনজীবী সমিতির তিন তিনবার সভাপতি নির্বাচিত হয়ে পুরো জেলার উকিলদের স্বার্থে গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন।

সকাল বা সন্ধ্যা তাঁর চেম্বারে মক্কেলদের উপস্থিতি লেগেই থাকতো। আর সাংগঠনিক প্রয়োজনে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ব্যক্তিবর্গ তো আছেনই। অর্থাৎ তাঁর ওই ছোট চেম্বারখানাতে লোকজনের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো ছিলো। হালেও আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব আছেন যাঁরা আইন ব্যবসা করেন। পেশার বাইরে তাঁদের খুব একটা সময় দিতে দেখা যায় না। অনেকটা ডাক্তারদের মতো। পেশা মানে টু-পাইস কামানো ছাড়া তাঁরা অন্য বিষয় ভাবতেই পারেন না। হোন তিনি উকিল, হোন তিনি ডাক্তার। উকিল সাহেব, (শুধু আমি নই সাংগঠনিক সবাই তাঁকে উকিল সাহেব নামেই ডাকতেন। এমনকি খোদ জেলা আমীর সাহেবও।) মানে ছালামতুল্লাহ্ এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। হ্যাঁ, তিনিও পেশাজীবী ছিলেন। কিন্তু সংগঠনের কাজ ফেলে পেশাকে বড় করে দেখেননি। হঠাৎ ঘটে যাওয়া পরিস্থিতি সামাল দিতে তাঁকে দৌঁড়-ঝাঁপ দিতে হতো। তখন পেশার কথা ভুলে যেতেন। তাঁর মুন্সীরও এবিষয়ে পূর্ব ধারণা ছিলো। অন্য উকিল দিয়ে মক্কেলদের মামলা-মোকদ্দমার কাজ চালিয়ে নেওয়া হতো। এ ব্যাপারে মক্কেল, বিচারক, আর সংশ্লিষ্ট পক্ষ নাখোশ হতেন। সংগঠনই তাঁর কাছে বড় ছিলো। বিষয়টি এ রকম, আমরা জীবন ধারণের প্রয়োজনে কত কাজই না করি। এই যেমন, খাওয়া-দাওয়া, বিশ্রাম-চিকিৎসা, চাকরি-বাকরি, লেখা-পড়া, দেশ-বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদি কতো কী। যাঁর জীবনের লক্ষ্য নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছে তিনি ওইসব বিষয়-আশয়কে জীবন ধারণের প্রয়োজনে করা একান্তই সাময়িক কাজরূপেই ধরে নেন। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যযুগে এক ব্যক্তি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছার লক্ষ্য নির্ধারণ করে কাফেলার সাথে সফরে বেরিয়েছেন। মরুময় পথে দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণ। উট ও পায়ে চলা পথ। পথে রান্না-বান্না করে খাওয়া-দাওয়া, তাঁবু খাটিয়ে ঘুম-বিশ্রাম, নিরাপত্তার জন্য প্রহরা, ডাকাতের সাথে সশস্ত্র লড়াই, অসুস্থ হলে চিকিৎসা নেওয়া, অর্থ-কড়ি ফুরিয়ে গেলে গতর খেটে আয়-রোজগার করা, সফর প্রলম্বিত হলে বিয়ে-শাদী করা ইত্যাদি বিবিধ কাজ-কাম করে তবেই লক্ষ্যপানে পৌঁছাতে হয়। কিন্তু কেউ যদি যাত্রাপথে করা আয়-রোজগারে স্থায়ীভাবে লেগে যান বা বিয়ে-শাদী করে তথায় থিতু হতে চান তাহলে তাঁর আর লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। ছালামতুল্লাহ্ সাহেবও জীবন চলার পথে বহুবিধ কাজের সাথে বিভিন্ন সময়ে সম্পৃক্ত হয়েছেন, সম্পৃক্ত থেকেছেন। কিন্তু তিনি জীবনের লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছিলেন। একজন প্রকৃত মুসলিমের জীবন লক্ষ্য হলো- রেজায়ে মাওলা বা আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জন। আর সে সন্তুষ্টি অর্জন করতে হয় দ্বীনে হক তথা ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য আজীবন নিরলস সংগ্রাম করার মধ্য দিয়ে। জীবনে তিনি বহুবিধ কাজের সাথে জড়িত ছিলেন বটে কিন্তু কোনটিকেই তিনি তাঁর নির্দিষ্ট করা জীবন লক্ষ্যের সাথে সাংঘর্ষিক বা সমান্তরাল ভাবেননি। বরং ভেবেছেন জীবন চলার পথের সাময়িক অনুষঙ্গ হিসেবে। কেউ কেউ তাঁর ওই সকল আপাত বিপরীতধর্মী কর্মকান্ডের প্রতি টিপ্পনি কাটেন অনেকটা এইভাবে ‘একজন উকিল কিনা ইসলামি দলের কান্ডারী’! আবার কেউ কেউ তাঁর চরিত্রে দ্বান্দ্বিকতা খুঁজে পান। উকালতি আর ইসলামি আন্দোলন- কেমন যেনো খাপ খায় না। কিন্তু তারা ভুলে যান, মানুষ হিসেবে দুনিয়াবী জীবন-যাপনের প্রয়োজনে করা বিভিন্ন কর্মকান্ড জীবনকে ক্ষেত্র বিশেষে প্রভাবিত করে বটে, কিন্তু যিনি তাঁর লক্ষ্যে স্থির, অবিচল, অনড় : জীবন চলার পথের সাময়িক অনুষঙ্গ তাঁকে লক্ষ্যচ্যুত করে না, দিকভ্রান্তিতে ভোগায় না। ছালামতুল্লাহ্ লক্ষ্যপানে স্থির, অবিচল, অনড় ছিলেন। তাইতো তিনি ক্ষণজন্মা। অন্য অনেকের চাইতে আলাদা।

কক্সবাজার শহরের বাহারছরা নিবাসী একজন বিশিষ্ট, সজ্জন, সবার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব নজির আহমদ। তিনি কক্সবাজার মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা। অত্যন্ত সৎ, কর্তব্যপরায়ণ, কর্মনিষ্ঠ, দ্বীনদার কর্মকর্তা হিসেবে সবার প্রিয়ভাজন ছিলেন। তাঁর নয়জন পুত্র সন্তান। তন্মধ্যে ছালামতুল্লাহ্ সবার বড়। সবক’টি সন্তানই বিদ্যা-শিক্ষা-পদ-পদবিতে বিশিষ্ট। তাঁদেরকে নবরত্ন বলে ডাকা হয়। ছালামতুল্লাহ্ ১৯৩৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পিত্রালয়ে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৬ জুন ২০২১ তারিখে ইন্তেকাল করেন।

আজকের এই দিনে কক্সবাজারবাসীর অতি প্রিয়ভাজন ক্ষণজন্মা (endowed with rare qualities) ছালামতুল্লাহ্র অসামান্য অবদানের কথা স্মরণ করতঃ তাঁর প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করছি। এবং মহান স্রষ্টা আল্লাহ্ সোবহানাহু ওয়া তায়ালার দরবারে তাঁর মাগফিরাত ও তাঁর জন্য জান্নাতুল ফেরদাউসের সুউচ্চ মাকাম কামনা করছি। আমীন, ইয়া রাব্বাল আ’লামীন।